নুপা আলম, কক্সবাজার।।
‘২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কক্সবাজার-৪ (উখিয়া-টেকনাফ) আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ভোট করে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন শাহীন আক্তার। এরপর উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির একটি সভায় একবারই তাকে দেখেছিলাম। এরপর এই এমপির চেহারাও আর কোনো দিন আমি দেখিনি।’
নিজ দলের এমপি প্রসঙ্গে প্রতিদিনের বাংলাদেশকে এ কথাগুলো বলেছেন টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নুরুল বশর। আগামী নির্বাচন নিয়ে তার সঙ্গে আলাপকালে কথা হয় বর্তমান এমপিকে নিয়েও। নুরুল বশর বলেন, ‘উখিয়া-টেকনাফের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এমপির দেখা পান না। নির্বাচনের পর পাঁচ বছর হতে চললÑ এর মধ্যে এলাকার জনগণও একটিবারের জন্য এমপিকে এলাকায় দেখেননি। জাতীয় শোক দিবসসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় দিবস কিংবা আওয়ামী লীগের দলীয় কর্মসূচিসহ কোনো অনুষ্ঠানে বারবার আমন্ত্রণ জানানোর পরও আসেননি এমপি। ব্যানারে অতিথি হিসেবে তার নামটাই শুধু থাকে। তার দেখা মেলে না। তিনি যেন পর্দার আড়ালের এক মানুষ!’ এলাকায় অনুপস্থিতির পাশাপাশি এমপির কর্মকাণ্ড নিয়ে আরও ভয়াবহ এক অভিযোগ তুলেছেন নুরুল বশর। এই আওয়ামী লীগ নেতার দাবি, গত পাঁচ বছরে এমপি শাহীন আক্তারের হয়ে সব সরকারি নথিপথে স্বাক্ষর করেছেন তার স্বামী!
শাহীন আক্তারের আগে তার স্বামীই এই আসনের এমপি ছিলেন। স্থানীয়ভাবে তো বটেই জাতীয় পর্যায়েও বহুল আলোচিত-সমালোচিত তিনি। তার নাম আবদুর রহমান বদি। বর্তমানে তিনি টেকনাফ পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী হিসেবে তিনি টানা দুইবার এ আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে বারবার উখিয়া-টেকনাফকেন্দ্রিক মাদক চোরাচালান চক্রকে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ ওঠায় সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। যদিও বদি বরাবরই এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি করা মাদক কারবারির তালিকায় তার পরিবারের একাধিক সদস্যের নাম রয়েছে।
এদিকে ২০১৪ সালের নির্বাচনের বিজয়ী হওয়ার পর ওই বছরের অক্টোবরে একটি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে তিন সপ্তাহ কারাভোগ করেন বদি। সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে ওই মামলা করেছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই মামলায় ২০১৬ সালে বদিকে তিন বছর কারাদণ্ড দেন আদালত। ওই সাজার বিরুদ্ধে বদির করা আপিল এখনও হাইকোর্টে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। দুদকের মামলা ও মাদকসংক্রান্ত সমালোচনার জেরে ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বদিকে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তবে তার বদলে কক্সবাজার-৪ আসনে মনোনয়ন পান বদির স্ত্রী শাহীন আক্তার। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাহীন শাহীন নৌকার প্রার্থী হিসেবে বিপুল ভোটের ব্যবধানে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এরপর গত পাঁচ বছরে এমপির কাজের মূল্যায়ন জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আদিল চৌধুরী প্রতিদিনের বাংলাদেশকে বলেন, ‘এমপি একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তিনি ছিলেন না। এই পাঁচ বছরের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে আমি এমপিকে দেখেছিলাম। এলাকার জনগণও কোনো উন্নয়ন কর্মসূচি, সরকারি-বেসরকারি অনুষ্ঠানে এমপিকে দেখেছেন বলে আমি জানি না।’
আদিল চৌধুরী আরও বলেন, ‘শাহীন আক্তার নামেই এমপি, তার পদটিকে লাঠি হিসেবে ব্যবহার করছেন তার স্বামী বদি। গত পাঁচ বছরে তাকে এই আসনে অঘোষিত এমপির ভূমিকায় দেখা গেছে। এমপি নিজস্ব বরাদ্দ থেকে শুরু করে সব কাজ বদিই নিজের মতো করেছেন।’
টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব মোর্শেদ বলেন, ‘পাঁচ বছরে দলের পক্ষে তাকে বারবার আমন্ত্রণ জানানো হলেও তিনি কখনোই সাড়া দেননি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, করোনা মহামারি, বন্যা, রোহিঙ্গা সংকটসহ কোনো বিপদে-আপদে তার দেখা মেলে না। সরকারের ত্রাণ সহায়তাসহ কোনো অনুষ্ঠানে তিনি আসেননি। এমনকি কক্সবাজারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় শাহীন আক্তার বাদে জেলার সব এমপি উপস্থিত ছিলেন।’
মাহবুব মোর্শেদ এমপির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘স্থানীয় ভোটার কিংবা নিজ দলের নেতাকর্মীদের খোঁজ না নিলেও কথিত আছে এমপি জামায়াত-বিএনপির লোকজনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। উখিয়া-টেকনাফের শত কোটি টাকার উন্নয়ন সরকার করছে। এতে শেখ হাসিনার নৌকা প্রতীকের প্রতি মানুষের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। কিন্তু এমপির জনবিচ্ছিন্নতার কারণে স্থানীয় পর্যায়ে তার কোনো জনপ্রিয়তাই নেই।’