সাঈদ মুহাম্মদ আনোয়ার/উখিয়া নিউজ টুডে।। ইয়াবার মতো ভয়ংকর মাদকের প্রসার ঘটানো মাফিয়া – সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির সহচরদের মধ্যে অন্যতম টেকনাফ উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান জাফর আহমদ। ৩১ অক্টোবর (বৃহস্পতিবার) রাতে গত রাতে ঢাকাস্থ পূর্ব বাসাবো এলাকার একটি বাসা থেকে তাকে আটক করে র্যাব-১৫। পরে তাকে টেকনাফ মডেল থানায় হস্তান্তরের পর কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে।
কক্সবাজারের র্যাব-১৫ এর সিনিয়র সহকারী পরিচালক (ল’ অ্যান্ড মিডিয়া অফিসার) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান সীমান্তের কুখ্যাত এই মাদক সম্রাট আটকের পর গণমাধ্যমে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, গত ৫ আগষ্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর টেকনাফে জাফরের নেতৃত্বে তার ছেলে দিদার মিয়া, শাহজাহান, ইলিয়াছ, রাশেদ ও সালাহউদ্দীন প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালায় ও বিএনপি নেতাকর্মীদের বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করে। এতে বহু লোক আহত হয়। এই ঘটনায় জাফরের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি মামলা হলে তিনি তার ছেলেদের নিয়ে গাঁ ঢাকা দেন জানান তিনি।
এর আগে ৮ সেপ্টেম্বর রাতে রাজধানীর ৩০০ ফিট এলাকা থেকে জাফরের ছেলে শাহজাহান মিয়াকে গ্রেপ্তার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-১৫ (র্যাব)। জাফরের উত্থান নিয়ে এর আগে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এ সংবাদ প্রকাশ করা হয়। সংবাদটি নজরে এলে তৎপর হয়ে উঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং যার সূত্র ধরে তাকে আটক করা হয়েছে বলে জানা গেছে। বদির বিশাল সম্রাজ্যে সেনাপতির ভূমিকা ছিলেন সাবেক দুই উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ ও জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী। মাদক চোরাচালান, অপহরণ, চাঁদাবাজি, দখলবাজি, হত্যাসহ বদির এসব অপকর্মের প্রধান সহযোগী ছিলেন এই দুইজন। তাদের মধ্যে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাফর আহমেদ এতটাই পারদর্শী ছিলেন যে বদি তাকে ডাকতেন ‘ওস্তাদ।‘ অন্যদিকে প্রধান শিষ্য তথা উখিয়ার সেনাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির বদির ‘শ্যালক’। ওস্তাদ আর শিষ্য শ্যালকের সহযোগিতায় পুরো দক্ষিণাঞ্চলে তৈরি হয়েছিল ‘বদি’র রাজত্ব।
টেকনাফ মাদক পাচারের সেনাপতি জাফর ধরা পড়লেও এখনো লাপাত্তা উখিয়ার সেনাপতি জাহাঙ্গীর :
টেকনাফ ছাড়িয়ে বদি নিজ শ্বশুরালয় পাশ্ববর্তী উখিয়াতেও প্রভাব বিস্তার করেছেন। নিজ ক্ষমতা বলে শ্যালক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরেীকে বানিয়েছেন ইউনিয়ন ও উপজেলা চেয়ারম্যান। একাধিক দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করা জাহাঙ্গীর কবিরের বিরুদ্ধে রয়েছে ইয়াবা পাচার, চাল আত্মসাৎ, খুন, জঙ্গিবাদে সহযোগিতা, সরকারি জমি দখল, সাংবাদিক মারধর, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেয়ার মতো গুরুত্ব অভিযোগ রয়েছে। শত কোটি টাকার মালিক জাহাঙ্গীর এমপি শাহিন আক্তারের ভাই ও আরেক এমপির শ্যালক হওয়ায় ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এতটাই ক্ষমতাবান ছিলেন যে উপজেলার বিভিন্ন কর্মকর্তা ও থানার পুলিশ সদস্যরাও তড়স্ত থাকতেন। এমনকি কর্মকর্তাদের সালামের উত্তর পর্যন্ত দিতেন না তিনি। তার কথায় চলতে হতো ইউএনও, ওসিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের। রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালে তার বিরুদ্ধে সরকারি ত্রাণ চাল আত্মসাতের অভিযোগে একটি মামলা হয়। তবে ক্ষমতা বলে সেটার বিচারপ্রক্রিয়া বন্ধ করে রেখেছেন। এছাড়া দুই কোটি টাকার বিনিময়ে জঙ্গী সংগঠনকে আস্তনা ও প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন তিনি। সে সময় র্যাব জঙ্গি আস্তনায় অভিযান চালাতে গেলে আটকে দেন জাহাঙ্গীরের সন্ত্রাসী বাহিনী। এছাড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলা, বিএনপির কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগ, বিএনপি নেতা হত্যা, সাংবাদিককে মারধরসহ একাধিক মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।
গত ১৬ বছরে জাহাঙ্গীর কবির ও তার অনুসারীরা দখল করেছে শত শত একর পাহাড় ও সমতল এলাকা। তার ভাই হুমায়ুন কবির চৌধুরী, তহিদ, মামুন, আবছার, মফিজসহ তার সন্ত্রাসী বাহিনী বনবিভাগের শত-শত একর জমি দখল নিয়েছে। এসব অপকর্ম সহজ করতে কয়েকটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর। জমি দখল, টেন্ডারবাজি ও প্রতিপক্ষকে দমন করতে তার রয়েছে নূর মোহাম্মদ বলী, শামসু বলী, মফিজ মিস্ত্রির নেতৃত্বে ৫০ জনের সশস্ত্র একটি বাহিনী। ডাকাত শাহজাহানের নেতৃত্বে গড়ে তুলেছিলেন ২০ জনের কিলার গ্রুপ। যেটি সন্ত্রাসী ও ডাকাতি করে জনমনে আতঙ্ক তৈরি করতেন। তার রয়েছে ১০ জন সশস্ত্র দেহরক্ষী। এসব গ্রুপ শুধু সন্ত্রাসী কার্যক্রম নয়, ইয়াবা চোরাচালান ও বার্মিজ চোরাই পণ্য চোরাচালানের কাজ করতেন। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় ছিল ১২ জনের একটি ব্লগার টিম। কেউ জাহাঙ্গীর কবিরের অপকর্মের প্রতিবাদ করলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হেনস্তা করাই ছিল এ দলের কাজ। তার এসব গ্রুপের সদস্যদের বিরেুদ্ধে প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ, রোহিঙ্গা নারীদের অপহরণ ও ধর্ষণের অভিযোগ থাকলেও জাহাঙ্গীর কবিরের কাছে বিচার পেতেন না ভুক্তভোগীরা। গ্রুপের সদস্যদের দিয়ে রাজাপালং ও উখিয়া উপজেলা পরিষদের কাবিখা ও টেস্ট রিলিফের প্রকল্পেও করেছে লুটপাট। এসব অপকর্ম করে জাহাঙ্গীর কবির আয় করেছে কয়েক শত কোটি টাকা। সে ও তার ভাই হুমায়ন কবির মিলে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম শহরে কিনেছেন হোটেল, জমি, ফ্ল্যাট। এছাড়া উখিয়া বাজার, কুতুপালং বাজার, কোর্ট বাজারে গড়েছেন মার্কেট, আবাসিক হোটেল। অর্ধশত কোটি টাকা ব্যয়ে নিজ এলাকায় করেছেন দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে দামী বাড়ি। এই বাড়িকে উখিয়ার তাজমহল হিসেবে চিনে উখিয়াবাসী। সম্পদ অর্জনেও থেমে নেই জাহাঙ্গীর কবির। বন বিভাগের দখলকৃত পাহাড় রোহিঙ্গাদের কাছে বিক্রি করে আয় করেছেন কয়েক কোটি টাকা।
এছাড়াও বদির স্ত্রী শাহীন আক্তারের ভাই জাহাঙ্গীর কবিরের আত্মীয়তা রয়েছে বিএনপি পরিবারের সঙ্গে। তার আরেক বোন জামাই কক্সবাজার-২ (কুতুবদিয়া-মহেশখালী) আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপি নেতা আলমগীর ফরিদ। বর্তমানে জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরী সাবেক সংসদ সদস্য আলমগীর ফরিদের সহযোগিতায় নিজেকে এখনো অধরা রেখেছেন বলে জানা গেছে । প্রথমে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে, পরে মহেশখালীতে অবস্থান নিলেও সমুদ্র পথ হয়ে চট্টগ্রাম এরপর কৌশলে যশোরের বেনাপোল সীমান্ত হয়ে প্রায় ১০ লক্ষ টাকার অবৈধ চুক্তিতে ভারতে জাহাঙ্গীর প্রবেশ করে থাকতে পারেন বলে এলাকায় গুজব রটেছে তবে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।