সাইফুর রহমান তপন।। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে কিছুদিন ধরে যে বাগ্যুদ্ধ চলছে, তা কি রাজনীতিতে নতুন মেরূকরণের ইঙ্গিত? কারণ প্রথমত, এর তীব্রতা চোখে পড়ার মতো। দ্বিতীয়ত, লড়াইটি চালাচ্ছেন দল দুটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তৃতীয়ত, সোমবার রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে প্রকাশিত জামায়াত সম্পর্কে নেতাদের মনোভাব।
সমকালের খবরমতে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ দেওয়ার উদ্যোগ বিষয়ে আলোচনা করতে আয়োজিত বৈঠকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হন। বৈঠকে নেতারা ‘আওয়ামী লীগকে মাইনাস করার পর বিএনপিকেও মাইনাস করার ষড়যন্ত্র’ চলছে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন। সে প্রসঙ্গে ছাত্রদের একটার পর একটা ইস্যু তোলার পেছনে কারা ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ জোগাচ্ছে– সেই প্রশ্নও তোলেন। এ প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে নেতারা ‘জামায়াতের প্রতি সন্দিহান’ হওয়ার কথা বলেন।
স্মরণ করা যায়, প্রায় সমমনা ভোটারগোষ্ঠীর ওপর নির্ভরশীল বিএনপি ও জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৯ সাল থেকে প্রায় আড়াই দশক জোটবদ্ধ। তবে তাদের মধ্যে অনানুষ্ঠানিক বোঝাপড়া ছিল আরও বহু আগে থেকে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর সরকার গঠনে জামায়াতের সহায়তা নেয় বিএনপি। মুক্তিযুদ্ধের পর নিষিদ্ধ জামায়াত পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ পায় বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের শাসনামলেই। দু’দল একসঙ্গে সরকারও গঠন করে ২০০১ সালে। অবশ্য শেখ হাসিনা সরকারের সর্বশেষ মেয়াদের শেষ দিকে দল দুটির মধ্যে দূরত্ব দেখা দেয়। তখন বিএনপি এ বিষয়ে নীরব থাকলেও জামায়াত নেতারা প্রকাশ্যেই বিএনপির সঙ্গে জোট না থাকার কথা বলেন। জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান দল দুটিকে আবারও কাছে আনলেও এখন কি দূরত্ব বেড়েছে?
সমকালের প্রকাশিত অন্য এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, দলটির ‘একাত্তরের বিরোধিতা’র কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে রোববার জামায়াত নেতাদের উদ্দেশে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘একটি দল নিজেরা মোনাফেকি করছে আর বিএনপিকে সবক দিচ্ছে; কলঙ্ক লেপনের চেষ্টা করছে।’ অনেককে চমকে দিয়ে রিজভী এমনকি জামায়াতের বিরুদ্ধে ‘রগকাটার রাজনীতি’ করার অভিযোগও আনেন। অতীতে বিভিন্ন সময় ছাত্রলীগসহ প্রগতিশীল সংগঠনের নেতাকর্মীর মতো ছাত্রদলের নেতাকর্মীও শিবিরের ‘রগকাটা’ রাজনীতির শিকার– এ অভিযোগ রয়েছে। ছাত্রদল নেতারাও বিভিন্ন সময় এমন অভিযোগ তুলেছেন। কিন্তু বিএনপি নেতাদের আগে কখনও জামায়াতকে একই অভিযোগে অভিযুক্ত করতে দেখা যায়নি।
অন্যদিকে রিজভীর কথা মাটিতে পড়ার আগেই এর নিন্দায় সরব হয় জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান রোববার এক বিবৃতিতে বলেন, জামায়াতের রাজনীতি ভারতের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। এ ভূমিকা জাতি গ্রহণ করেছে। এ কারণেই সম্ভবত রিজভীর ‘গাত্রদাহ’ হয়েছে। তিনি রগকাটা ও ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের রাজনীতির অভিযোগ অস্বীকার করার পাশাপাশি জামায়াত মোনাফেক নয় বলে দাবি করেন। বরং ‘২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত জোটকে এড়িয়ে ভিন্নমতের সঙ্গে জোট গড়ে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে ঐক্য বিএনপি করেছিল’, তাকেই তিনি ‘জাতির সঙ্গে মোনাফেকি’ বলে মনে করেন (সমকাল, ৩০ ডিসেম্বর, ২৪)।
বিএনপি তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে জামায়াতের বিবৃতির স্ক্রিনশট এবং জামায়াত আমির ডা. শফিকুর রহমানের ২০১৮ সালের নির্বাচনী পোস্টার দিয়ে তৈরি ফটোকার্ড পোস্ট করে কালবিলম্ব না করেই এর জবাব দেয়। রোববার রাতেই দেওয়া ওই পোস্টের ক্যাপশনে লেখা– ‘২০১৮ সালের নির্বাচনে জামায়াত দর কষাকষি করে ২২ আসন বাগিয়ে নেয় জোট থেকে এবং সে নির্বাচনে ডা. শফিকুর রহমান নিজেও ধানের শীষ প্রতীকে প্রার্থী হয়েছিলেন। তাহলে কার সঙ্গে জোট? আর কার সঙ্গে মোনাফেকির কথা বললেন আমির?’
মূলত ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী রাজনৈতিক পরিস্থিতিই বিএনপি-জামায়াতের সম্পর্ককে এ জায়গায় নিয়ে এসেছে। আমরা দেখেছি, অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রায় সর্বস্তরের নেতা এবং এমনকি পরিচিত কর্মীরাও দেশের ভেতরে ও বাইরে আত্মগোপনে চলে যান। রাজনীতির ময়দানে বিএনপি ও জামায়াতের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা পায়। তখন দৃশ্যত গণঅভ্যুত্থানের ‘মালিকানা’ দখলে নিতে দুই দলের নেতারাই আন্দোলনে নিজেদের কতজন হতাহত হয়েছেন, সেই পরিসংখ্যান দিতে থাকেন। একই সঙ্গে বিভিন্ন ঘটনায় প্রকাশিত হতে থাকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের ঘনিষ্ঠতা বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের চেয়ে বেশি। বিশেষত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির রূপ বিষয়ে শিবির ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যৌথভাবে ছাত্রদলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। কোথাও কোথাও উভয় পক্ষ দ্বন্দ্ব-সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ে।
জাতীয় রাজনীতিতেও সংস্কার এবং দ্রুত নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি। এর মধ্যে জামায়াত হয় মাঝামাঝি অবস্থান নিচ্ছে, নয় তো খোলাখুলি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে সুর মেলাচ্ছে। এ রকম পরিস্থিতি বিএনপির জামায়াতবিরোধী হয়ে ওঠার জন্য যথেষ্ট।
আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনাবলি অন্তত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যাশা অনুসারে এগোলে অদূর ভবিষ্যতে গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ও মাঠছাড়া আওয়ামী লীগের সক্রিয় রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা ক্ষীণ। এ অবস্থায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে নিয়ে গঠিত দীর্ঘদিনের দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থাটিও ভেঙে পড়ার উপক্রম। সম্ভবত এরই সুযোগ নিতে চাইছে জামায়াত। আওয়ামী লীগ-বিএনপির পাল্টাপাল্টি রাজনীতিতে যে কোনো মূল্যে নৌকা ডোবানো আওয়ামীবিরোধী সব ভোটারের দায়িত্ব হয়ে দাঁড়ায়। তাই অন্য কোনোদিকে না তাকিয়ে বিএনপির পেছনে সারিবদ্ধ হয় তারা। কিন্তু আগামী নির্বাচনে যদি সত্যিই আওয়ামী লীগ না থাকে তাহলে বিএনপির পেছনে ওই ভোটারদের দাঁড়ানোর দায় কমে যায়। উপরন্তু, জামায়াত যদি তার মিত্রদের– অন্য ইসলামী দল ও ছাত্রদের প্রস্তাবিত দল নিয়ে একটা দৃশ্যমান শক্তি গড়ে তুলতে পারলে অপেক্ষাকৃত নতুন শক্তি হিসেবে তাদের পক্ষে ভোট টানা সহজ হতে পারে। সম্ভবত এ কারণেই বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিএনপি তাকে ‘মাইনাস’ করার ষড়যন্ত্র দেখছে। লক্ষণীয়, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের বিচারের আগে কোনো নির্বাচন হবে না– কথাটা বৈষম্যবিরোধী ছাত্রনেতারা জোর দিয়ে বললেও বিএনপি এক প্রকার মৌনতা অবলম্বন করে; যদিও তারা এ বিচারের বিরোধী নয়। এ ইস্যুতে জামায়াতও ছাত্রনেতাদের সুরে কথা বলছে।
আরও লক্ষণীয়, বিএনপির শীর্ষ নেতা অনেকেই একাধিকবার আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে পরাজিত করার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। তার সূত্র ধরে সব দলকে বিএনপি নির্বাচনে চায়, এমন কথা বলে খোদ প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দেশের অন্যতম বড় দলের মতামতকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। এখন ঘটনাবলি বিএনপির প্রত্যাশা মেনে এগোলে পুরোনো দ্বিদলীয় সমীকরণেই আগামী নির্বাচন হবে। তখন নিজেদের সাধারণ শত্রু নৌকা ডোবাতে বিএনপি ও জামায়াত, এমনকি ছাত্ররাও যে আবার পরস্পর হাত ধরবে না– তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।
সূত্র; সমকাল