ওমর ফারুক হিরু/উখিয়া নিউজ টুডে।। দীর্ঘ ১৬ বছরের অপেক্ষার অবসান। অবশেষে পরিবারের কাছে, মায়ের সানিধ্যে ফিরেছেন সাবেক বিডিআর সদস্য মোহাম্মদ ইউছুফ। পিলখানা হত্যাকান্ডে দীর্ঘ কারাবাসের পর এ যেন এক নতুন জীবন ফিরে পাওয়া। যা উৎসবের উপলক্ষ এনে দিয়েছে পরিবারের কাছে। তবে ছেলে ফিরলেও কারাগারে তাঁর জীবন থেকে হারিয়ে ফেলা ১৬টি বছর কি আর ফিরবে? এ ক্ষতি কি কখনও পূরণ হবে? –এমন প্রশ্ন পরিবারের।
তখনকার ২২ বছর বয়সের অবিবাহিত এই যুবকের বয়স এখন ৪০ বছর। কারামুক্ত হয়ে বাড়ি ফিরে আসলে এলাকাবাসীও ইউছুফকে গ্রহণ করেন সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে। তার বাড়িতে শুভেচ্ছা জানাতে যান ইউছুফের মত পিলখানা হত্যাকান্ডে ক্ষতিগ্রস্থদের সংগঠন ‘এক্স বিডিআর কক্সবাজার ২০০৯’। অন্তবর্তী সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতার পাশাপাশি তাদের দাবী ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা। এদিকে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর সন্তানকে ফিরে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা ইউছুফের মা’।
কেমন ছিল জীবন থেকে হারিয়ে ফেলা ১৬ বছর? মোহাম্মদ ইউছুফ বলেন, ‘আমি ২৪ বছর বয়সে ২০০৮ সালের জানুয়ারীতে বিডিআর’-এ যোগদান করি। তখন আমি ড্রিগ্রি’র ছাত্র। পরে পিলখানা হত্যাকান্ডের ঘটনায় ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারীর ৯ এপ্রিল গণগ্রেফতারের আমিও গ্রেফতার হই। ওই সময় আমি কেন্দ্রিয় বিডিআর হাসপাতালে কর্মরত ছিলাম। আমার বিরুদ্ধে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা রুজু করা হয়। যদিও এসবের কিছুই জানিনা। এই মামলায় প্রথম দুই বছর (২০০৯-১০) কাশিমপুর কারাগারে পরে বাকী সময়টা ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে রাখা হয়। ২০১৩ সালে হত্যা মামলা থেকে খালাস পেলেও বিস্ফোরক মামলায় বাকী জীবন কেটে যায় ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া জেল থেকে মুক্ত হলাম। এর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ছাত্র-জনতা সহ সর্বস্থরের জনগনের প্রতি। সবার কাছে একটাই প্রত্যাশা, আর কোন নিরপরাধ বিডিআর যেন এই শাস্তি না পায়। যারা নিরপরাধ তারা যেন আমার মত মায়ের কোলে ফেরত আসেন। তবে অপরাধীদেও শাস্তি কামনা করছি।
পরিবারের অনুভূতি নিয়ে ইউছুফ বলেন, ছয় ভাই-বোনের মধ্যে আমি সবার বড়। পরিবাদ আর্থিক সচ্ছলতার জন্য বিডিআরে যোগদান করি। কিন্তু এই ঘটনার ফলে বিষয়টি উল্টো হয়ে গেল। আমার পরিবারকেই ১৬ টি বছর আমাকে দেখতে হয়েছে। তারা আর্থিক সহ নানাভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। ১৬ টা বছর আমার জীবন থেকে চলে যাওয়া মানে অবশিষ্ট আর কিছুই রইলনা। তবে সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হলো বাবা-মা’কে জীবিত পেলাম। আর আমি ফিরে এসেছি।
মোহাম্মদ ইউছুফ উখিয়া উপজেলার মহুরী পাড়ার টেকনিকেল কলেজ সংলগ্ন মোহাম্মদ ইলিয়াসের বড় ছেলে। ঢাকার বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১ যে ২০৫ জন বিডিআর সদস্যকে খালাস দিয়েছিল তার মধ্যে মোহাম্মদ ইউছুফ একজন। তিনি গত ২৩ জানুয়ারী জেল থেকে মুক্তি পেয়ে অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসা নেন। পরে ২৬ জানুয়ারী নিজ বাড়িতে ফিরেন। বিশাল সংবর্ধনার মধ্য দিয়ে তাকে এলাকাবাসী ও পরিবারের লোকজন গ্রহণ করেন।
মোহাম্মদ ইউছুফকে ফিরে পেয়ে সবচেয়ে বেশি খুশি তার মা’ রানু বেগম। তিনি জানান, ‘মা হিসেবে সন্তানকে ফিরে পেয়েছি এর চেয়ে আনন্দের আর কিছু হতে পারেনা। বড় সন্তান ইউছুফ বিডিআরের চাকরি পাওয়াতে অভাবের সংসারে আশার বুক বেঁধেছিলাম। কিন্তু এই ঘটনায় অভাবও মিটলনা সন্তানের সুখও পাইলামনা। আর কোন মায়ের যেন এই করুণ দশা না হয়। আমার ছেলের মত যত নিরপরাধ সন্তানকে জেল হাজতে থাকতে না হয়।
ইউছুফের ছোট ভাই আবু বক্কও ছিদ্দিক বলেন, বড় ভাই জেলে পড়ার পর আমার পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে যায়। আমার মা’ প্রায়’ই অজ্ঞান হয়ে যেত। পরে জোড়া তালি দিয়ে পরিবারকে ধরা রাখা হয়েছে। ১৬ বছর পর ভাইকে পেয়ে কি যে ভাল লাগছে তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবেনা। পুরো এলাকাবাসী আমার ভাই’কে স্বাগত জানিয়েছে। এই অবস্থায় অন্তবর্তী সরকারের কাছে দাবী আমার ভাই সহ যেসব নির্দোষ বিডিআর সদস্য রয়েছে তাদের যেন মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। তাদের চাকরিতে পুনর্বহালের পাশাপাশি পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়।
ইউছুফের ছোট ভাইয়ের ছেলে শিশু মোঃ সামির (৮) জানায়, আমার বড় আব্বুকে পেয়ে অনেক ভাল লাগছে। বড় আব্বুকে আর কোথাও যেতে দেবনা।
শুধু ইউছুন নয় পিলখানা হত্যাকান্ডে বিভিন্ন মেয়াদে জেলখাটা বিডিআরদের একেক জনের গল্প একেক রকম। তারা চাকরি করে পরিবারের দায়িত্ব নিতে গিয়ে এই ঘটনার ফলে তাদের’ই দায়িত্ব নিয়েছে পরিবার।
বড় মহেশখালীর মৃত জালাল উদ্দিনের ছেলে সাবেক বিডিআর সদস্য মোঃ রেজাউল করিম জানান, নিরপরাধ বিডিআরদের মুক্তি দেওয়ায় অন্তবর্তী সরকাকে ধন্যবাদ জানাই। এই সরকারের কাছে অনুরোধ ক্ষতিগ্রস্থ বিডিআরদের যেন সযোগিতার হাত বাড়ায়। যাদের এখনো বয়স আছে তাদের যেন পুনরায় চাকরিতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। বিডিআরদের ক্ষতিগ্রস্থ পরিবাকে যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। এছাড়া যাদের বয়স নেই তাদের যেন পেনশনের আওতায় আনা হয়।
‘এক্স বিডিআর কক্সবাজার ২০০৯’ এর সভাপতি হাবিলদার মোঃ একরাম উল হুদা জানান, পিলখানা হত্যাকান্ডে কক্সবাজারের ৫৭ জন বিডিআর ক্ষতিগ্রস্থ। তার মধ্যে ইউছুফ একজন। এর মধ্যে মহেশখালীর শওকত ও সদর উপজেলা খুরুশকুলের কাঞ্চন মারা গেছেন। ইউছুফের জীবন থেকে ১৬ টি বছর হারিয়ে গেছে। যা কেউ পূর্ণ করে দিতে পারবেনা। অন্তবর্তী সরকারের কাছে আমাদের দাবী ইউছুফ সহ ক্ষতিগ্রস্ত বিডিআরদের যেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়। ক্ষতিগ্রস্থ বিডিআরদের মানবেতর দিন কাটছে।
ইউছুফের বাড়িতে শুভেচ্ছা জানাতে যাওয়া ‘এক্স বিডিআর কক্সবাজার ২০০৯’ এর অন্যান্যদের ক্ষতিগ্রস্ত বিডিআরদেও মধ্যে ছিলেন, মহেশখালীর জালাল উদ্দিনের ছেলে রেজাউল করিম, কক্সবাজার সদরের মৃত ওবাইদুল হাকিমের ছেলে শামশুল আলম, সদর উপজেলা খুরুশকুলের মোহন কান্তি দে’র ছেলে কৃষাণ কান্তি দে, ঈদগাঁহ এর মৃত মমতাজ আহম্মদের ছেলে মো: ধুধু মিয়া, উখিয়ার শামসুল আলমের ছেলে সাইফুল ইসলাম, উখিয়ার মকবুল আহমদের ছেলে খোরশেদ আলম, খুরুশকুল সদরের রশিদ আহমদের ছেলে জহির উদ্দিন ও ঈদগাঁহ উপজেলার মৃত রফিক উল্লাহর ছেলে আবু বক্কর ছিদ্দীক।